ভারি বর্ষণ, কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকটি কেঁচ সবে মাটি ফুঁড়ে উঠে এল
বর্ষায় ভিজতে। এমন সময়
ওপাড়ার বল্টু দা রঙিন ছাতায় মাথা মুড়ে আসছিল। চারিদিকে শুন্শান্ তবে টিপটিপ বৃষ্টির
শব্দ বেশ ছন্দময় ছিল। কিন্তু
যেতে যেতে হঠাৎ একটা বাঁশির শব্দ শুনল পিছনের
সরু গলিটার ভিতর থেকে। কি হল!
কি হল! হঠাৎ মনের মাঝে প্রশ্নের উদায়। মিনিট কয়েক যেতেই বুঝতে পারল একজন
লোক তার দিকে ছুটে আসছে। একটু ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল বল্টু দা। কিন্তু অবাক কান্ড, লোকটা কিছু একটা ফেলে চলে গেল- ডাক দিতেই দ্রুত চলে গেল লোকটি।
সাদাসিধে বল্টু দা বুঝল না, ব্যাপারটা কি। ছোট একটা
প্যাকেট, হাতে তুলে নিল। প্যাকেটটা খুলতেই একটা সোনার ঘড়ি
দেখল। ‘কি তাজ্জব ব্যাপার,
এ দেখি সোনার
ঘড়ি। এত মূল্যবান অথচ ফেলে গেল
কেন?’ প্রশ্নটা অজান্তে করেই বসলেন নিজেকে।
যে কয়েক জন লোক অদূরে দাঁড়িয়ে ছিল তারা ছুটে এল এবং ছোঁ মেরে
প্যাকেটটা নেওয়ার চেষ্টা করল। অমনি বল্টু দা বলে উঠল, ‘কারা তোমরা?, এই প্যাকেটটা ওই লোকটি ফেলে গেছে, এটা তাকে ফেরত দেব। তোমরা ছড় আমাকে।’
‘কোন কথা বলবি না। চুপচাপ দিয়ে দে, নইলে ঠাং ভেঙে এখানেই ফেলে দেব, বুঝলি!’ গোঁফওয়ালা কেলে মানুষটার
কথা শুনে বল্টু দা বুঝতে পারল এরা সাধারণ মানুষ নয়, গুন্ডা। বল্টু
দা কোন ঝামেলায় না জড়িয়ে দিয়ে দিল।
হাঁটতে হাঁটতে মোড়টা পেরিয়ে দেখে বৃষ্টির গতি আর বাড়ছে। কোন উপায় না দেখে বল্টু দা একটা দেওয়ালের
পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল বৃষ্টি থামার অপেক্ষায়। আস্তে আস্তে শরীরে শীতবোধ হতে লাগল। চোখ ঘোরাতেই একটা ছোট পাখিকে দেখে
তার খুব মায়া হল। পাখিটার
নিকট গিয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিল। কিন্তু তার গায়ে রক্ত দেখে আর দুঃখ পেল। হাতটা তার শরীরে রাখতেই চুপচাপ হয়ে
গেল, যেন পাখিরাও মানুষের আদর বোঝে।
যে পাখি মানুষ দেখলে ভয়ে পালায় সে আজ মানুষের হাতে ছাতার নিচে
নিরাপদবোধ করল। কিন্তু
কেন? এই প্রশ্নের উদয় হল তার মনে। সে পাখিটাকে হাতে ধরে এদিক-সেদিক
তাকাল। একটু পাশেই একটা গাছের ডালে
একটা বাসা দেখতে পেল। বাসার
দিকে যেতেই পাখিটা চিৎকার করে
উঠল। বল্টু দা গিয়ে দেখে তার বাসায়
একটা সাপ বসে আছে। ডিমগুলো
খেয়ে ফেলেছে। যদি ভুল
করে হাত দিত তাহলে কি হত, মনটা সেই ভেবে আতকে উঠল।
বল্টু দা এবার বুঝতে পারল, কেন পাখিটা বৃষ্টিতে ভিজছে। বৃষ্টি থেমে গেলে পাখিটাকে নিরাপদে রেখে বাড়িতে ফিরবে। একটা ছোট লাঠি দিয়ে সাপটাকে সরাতে
গেল, কিন্তু তার দিকে ফনা উঠিয়ে ফোস ফোস
করতে থাকে।
আস্তে আস্তে
সরে গেল- কিন্তু আবার যদি আসে! বাড়িতেই নিয়ে
কোথায় রাখি!
বৃষ্টি থেমে গেল। বল্টু দা অন্য একটা ডালে পাখিটাকে রেখে বাড়ির উদ্দেশ্যে চলতে
শুরু করল। কেউ যেন আবার সামনের দিক
থেকে ছুটে আসছে দেখে আবার দাঁড়িয়ে পড়ে। লোকটি বল্টু দাকে না দেখে প্যাকেটটা যেখানে ফেলেছিল সেখানে ঘুরাঘুরি
করতে থাকে।
লোকটি কিচ্ছুক্ষণ
খোঁজাখুঁজি করে অদূরে কাউকে দেখে অন্য রাস্তা দিয়ে চলে গেল। এমন অবস্থা দেখে বল্টু দা’র বুঝতে বাকি রইল না যে, সোনার ঘড়িটাই এর রহস্য।
বল্টু দা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হল। মনটা খুবই ভীতিকর আবার সুখকর মনে
হল। একদিকে পাখিটাকে কিচ্ছুক্ষণ
নিরাপত্তা দিতে পারায় আন্য দিকে গুন্ডার আতংক। বাড় ফিরতে ফিরতে এইসব ভাবতে থাকে
বল্টু দা।
বাড়ি ফিরেই ছোট ভাই গিল্টু কে বলল- গিল্টু, বাড়ির পিছনে যে গাছটা আছে
সেই গাছে কোন পাখির বাসা আছে কি না। যদি থাকে তবে তাকে জানাতে বলল। ঠিক আছে দাদা, তাই হবে এই বলে বেরিয়ে গেল গিল্টু। এরই মধ্যে ছোট পাখিটা তার বাড়তে এসে
উঠল। বারান্দার এককোণে কিছু জিনিস
রাখার জন্য তক্তা রাখা ছিল, তার পাশে পাটের আঁশ। পাখিটা ওখানেই বসে পড়ল। এই দৃশ্য দেখে বল্টু দা’র মুখে হাসি ফুটল।
যথারীতি পাখি ও বল্টু দা’র
গল্প বলা শুরু হল। প্রত্যেক
দিন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প হয় তাদের মধ্যে।
আজ পরিবেশটা বেশ সুন্দর মনে হল তাই বাইরে বের হল। কিন্তু বাইরে বের হওয়ার সময় কেউ যেন
তাকে অনুসরণ করছে- এমন মনে হল তার। মাঝে মাঝে পিছন ফিরে দেখতে থাকে। কখনো কখনো অদূরে একজন ব্যক্তিকে দেখা
যায়। শুধু আশ্চর্য্যরে বিষয় হল- লোকটি সেই লোক, যে লোকটি বৃষ্টির মাঝে প্যাকেটটা
ফেলে গিয়েছিল। বল্টু
দা ভয়ে ভয়ে পথ চলে। হঠাৎ
একটা লোক তাকে সম্বোধন করে বলল, আরে মশাই কেমন আছেন? এলাকায় নতুন এসেছি! ব্যাবসা-ট্যাবসা করি, আপনি?
একটু অবাক হয়ে গেল,
কিন্তু সামলে
নিয়ে বলল- আমি বাপু ঘোষেদের বাড়ির কারখানায়
হিসাব নিকাশের চাকরি করি। ওই---- ওপাশের দু’টা রাস্তা পর আমি থাকি। তা মশাই আজ আসি পরে দেখা হবে। আগান্তুকের কথা শুনে বল্টু দা বলল, কোন ধরনের ব্যাবসা করেন বলবেন কি? শুনে আগান্তুক বলল,
অন্য দিন বলব
মশাই।
বল্টু দা কিছুই বুঝতে পারল না। কিছু শোনা আগেই রহস্যময়ভাবে এসে রহস্যময়ভাবে
চলে গেল। বল্টু দা আবার চলতে শুরু
করল ঘোষ বাড়ির দিকে।
আজ ফিরতে একটু দেরি হল। অন্য দিন তিনটায় বাড়ি ফেরে, আজ পাঁচটা বেজে গেল। রাস্তার মোড়ে আসতেই অচেনা সেই লোকটা প্যাকেটের সন্ধানে আবার
এসেছে দেখল। আজ মুখমুখি
হয়ে গেল। লোকটি ভদ্রতার সাথে বল্টু
দা’কে ডেকে বলল- দাদা, কয়েকদিন পূর্বে একটা প্যাকেট
বৃষ্টির মাঝে ওই মোড়টায় পড়ে গিয়েছিল। আপনি ওখানে ছিলেন,
প্যাকেটটা যদি
ফেরত দিতেন, খুব উপকার হত। আমার বড় ক্ষতি হয়ে যাবে দাদা---!
ওই দিনেই কিছু লোক এসে আমার কাছ থেকে সেটা কেড়ে নিয়ে গেল। ওদের মাঝে একটা গোঁফওয়ালা কেলে
(কাল) মানুষ ছিল, সেই লোকটা একটা ছুরি বের করল, আমি ভয়ে সেটা দিয়ে দিলাম। কিন্তু দাদা আমার তো জীবন-মরণ সমস্যা
হয়ে গেল! ঠিক আছে ভাই, ওখানে বসে কথা বলি!
বল্টু দা তাকে নিয়ে বসল। সুন্দরভাবে শুনল, কি তার সমস্যা।
আসলে দাদা ওই জিনিসটা মি.কেলিটন সাহেবের। তিনি ওটা আমায় দিয়েছিলেন উপহার হিসেবে। কিন্তু কেলিটন সাহেব যেটা আমায় দিতে
চেয়েছিলেন সেটা ভুল করে থেকে গেছে বাসায়। আর ওই প্যাকেটটা আমায় দিয়েছিলেন। কেলিটন সাহেব বললেন ১ নম্বর প্যাকেট
তোমার জন্য আর ২ নম্বর প্যাকেটটা আমার। ১ নম্বরে আছে একটা সোনার হার আর ২ নম্বরে আছে একটা সোনার ঘড়ি। আজ সকালে কেলিটন সাহেব বললেন।
কিন্তু সেটা মুখ্য বিষয় নয়। মুখ্য বিষয় হল সাহেবের ঘড়িটা অনেক
দামী। তাছাড়া ওই দিনে কেলিটন সাহেবের
বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল। আমাকে
ভুল করে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিল। পিছনের দরজা দিয়ে আমরা দু’জনে
পালিয়ে গেলাম।
তা এতো দামী উপহার?
কেলিটন সাহেব গতবছর সোনার দোকান থেকে আনেক-কে গয়না বানাতে উদ্বুদ্ধ
করেন। সাথে সাথে থাকতাম বলে তিনি
আমাকে পছন্দ করতেন। সেই সূত্রে
স্বর্ণকারের আনেক টাকা লাভ হয়। তা ছাড়া বিদেশে গেলে স্বর্ণকার বাবুরা তাঁর কাছে স্বর্ণ আনতে
দিতেন। কারণ কেলিটন সাহেব মস্তবড়
পরিবার থেকে এসেছেন। তাঁর
বহু লোক জানাশুনা আছে। তাঁর
পাসপোর্ট-ভিসা প্রায় সব দেশে যাওয়ার জন্য অনুমোদিত।
ও আচ্ছা---! কিন্তু কি করার এখন!
তাই তো ভাবছি মশাই। ঠিক আছে চলেন থানায় একটা ডাইরী করি। তাই চলুন।
পথের মধ্যে সেই গুন্ডার দল তাদের ধরে বসল। অনেক কথা কাটাকাটি হল। তারা বলল অন্য প্যাকেটটা কোথায়, তাদের দিয়ে দিতে বলল। আচেনা মানুষটি বলল,
ওটা তো নেই
চুরি হয়ে গেছে। জীবন
বাঁচাতে মিথ্যে বলল। কিন্তু
কেউ বিশ্বাস করতে চাইল না। বল্টু দা’কে বেদম মারল এবং আন্য ব্যক্তিকে
তুলে নিয়ে গেল। বল্টু
দা ভয়ে ভয়ে বাড়ি ফিরল। গিল্টু
কে বলল, আজ থেকে সে বাইরে যাবে না, ঘরেই থাকবে। আর গিল্টু যদি পারে তবে যেন তার চাকরিটা সে করে।
গিল্টু দা তার দাদা’র চাকরি নিয়ে ঘোষ বাড়িতে
যেতে থাকে।
আর সময় অনুযায়ী
গিল্টু’র বাড়ি ফেরার পথে বল্টু দা তাকিয়ে
থাকে।