(৩) শেষ অংশ
সকাল দশটা। দিপু টগর-এর অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছে। সব আয়োজন সমাপ্ত। হঠাৎ কড়া নাড়ল সদর দরজায়। দরজা খুলতেই অনেক লোকের ভিড় দেখে আতকে
উঠে দিপু-র স্বামী সজীব জিজ্ঞাসা করল। কি হল, সবাই এত ভিড় করেছেন কেন? আর এই লোকটি বা কে? পাশ থেকে একজন
বলে উঠল, দাদা- লোকটি অনেক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবছিল আর বিড়বিড় করে কি-সব উল্টাপাল্টা
বকছিল। সন্দেহ
হল তাই ধরে এনেছি।
আচ্ছা, ঠিক
আছে! আপনার নাম কি? কোথা থেকে এসেছেন? লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন সজীব সাহেব। উত্তরে আগান্তুক বলল, দিপু কে? তাঁকে
একটু ডেকে দিন না! খুব দরকার!
কেন, কি হয়েছে?
আমায় বলুন, আমি তার স্বামী।
টগর নামে এক
ভদ্রলোক এই পত্রখানা দিয়েছে। তিনি এখানে আসতে গিয়ে সন্ত্রাসীর গুলিতে গুরুতর আহত হয়েছেন। মুমুর্ষ অবস্থায় হাসপাতালে আছেন।
মুহূর্তে স্তব্ধ
হয়ে গেল সকল ব্যক্তির হৃদস্পন্দন। এমন একজন ব্যক্তি, যে-কিনা এমন একটা খবর আনল, তাকে সন্দেহের বসবর্তী
হয়ে হেনস্থ করল! অবশ্য না বুঝে করেছে। বাড়ির ঠিকানা ঠিক-ঠাক না বুঝতে পেরে বিড়বিড় করে পড়ছিল, এই বাড়িটা
হবে, না--- ঐ বাড়িটা হবে। সজীব সাহেব সবার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে বললেন, ইনি আমার অতিথি।
আগান্তুককে
বসার ব্যবস্থা করে পত্রখানা দিপু-র হাতে দিল।
দিপু পত্রখানা
পড়তে শুরু করল-
দিপু,
এটা তোমার কাছে
লেখা আমার প্রেম পত্র নয়Ñ সেটা হলে অনেক দ্বিপক্ষীয় দ্বিধা-সংশয়-সংকোচ জাপটে ধরবে। তবুও বলছি-
না চাইতে প্রেম-ভালবাসা
আমি সবাইকে দিয়ে থাকি, তার উপলক্ষ্য মাত্র উন্মোচিত হল। আবার, ভুল বুঝে দূরে সরে যেও না। বিধাতা আমাকে সেই প্রেম-ভালবাসা দিয়েছে
অফুরন্ত, না হয় কিছুটা তোমায় দিলাম।
আমি আবার বলছি,
এটা তোমায় লেখা প্রেম পত্র নয়, আমার হৃদয়ের কথা। অনেক দিনের জমানো কথা, শেষ হবে না এক
পাতায় তবুও বলছি, আমি সেই মানুষকে ভালবাসি যার সুন্দর একটা মন আছে, রূপের অহংকার থাকে
না।
ছোটো কালে মানুষ
না-চিনে কথা কইতাম, কিন্তু আজ মানুষকে চিনতে শিখেছি, তাই চোখ দু’টি দেখলে মুখমন্ডলে
ভেসে উঠে তার ভেতরকার ছবি- পড়তে শিখেছি সেই ছবির ভাষা।
আমি শান্ত ও
চঞ্চল প্রকৃতিকে বেশি ভালবাসি তাই যেখানে শান্ত ও দুষ্ট-মিষ্ট ভাবের আদান-প্রদান ঘটে
সেখানে আমার অবস্থান দীর্ঘ হয়, নয়তোবা চলে যাই সীমাহীন আড়ালে, খুঁজে পাওয়তো দূরে থাক
স্বপ্নেও দেখা মেলে না।
আমার দু’টি
রূপ আছে। একÑ
পাগলামি-
গাছ-প্রকৃতি,
চাঁদের আলো, জোনাকি আমাকে ডাক দিয়ে যায়। দুই- অনাচার মুক্ত সভ্য সমাজে বেঁচে থাকার
ক্ষুদ্র প্রয়াসÑ কিছু কিছু খারাপ প্রবণতা থেকে বিরত রাখি এই প্রেমী সত্ত্বাকে।
খুব শিঘ্রই
আরেকটি রূপের সন্ধান মিলবে, অপেক্ষায় আছি, পেয়েও যাব।
জানি অনেক বাঁধা
পেরোতে হবে। কিন্তু
ভয় পাই না সীমান্তের কাঁটা তারের বেড়াÑ একটু ভীত হই যন্ত্রনার আগুনে। অনেক পুড়েছি তুষের মতো, এবার কয়লা হতে
চাই, যার অনেক মূল্য আছে কর্মকারের উঠানে।
একটা স্বপ্ন
আছেÑ
পতœী রূপে কাউকে
পাওয়া। এ---ই---
শ্যামলা বরণ, প্রকৃতির মত রূপ মাধুর্য্যে ভরা, পিতার ইচ্ছে সঙ্গিতে হাতে খড়ি রয়েছে
এমন।
যথার্থ বিচারে
হয়তো গেঁয়ো, কিন্তু সবুজ বনানী শুধু গাঁয়ে দেখা যায়, শহরে শুধু ধোঁয়া-শব্দের মিতালী। তাই নিজেকে গেঁয়ো বলতে ভালবাসি।
ভাবছ, এতো কথা
কেন?
বন্ধুকে চিনে
নিয়ো, কষ্ট যাতে না হয়।
--হারিয়ে যাবে
কাগজটি, সংরক্ষণের জায়গা এখনো তৈরি হয়নি। তবে কথাগুলো এ-মন থেকে কখনো মুছবে না।
এখন দিগন্তে
চেয়ে কিছু স্বপ্নের আলোক রেখা দেখি, কাল হয়তো সেটাও থাকবে না এ-জীবনে। দৃষ্টিতে ভাঁটা পড়বে, প্রদীপ নিভে যাবে
ঝড়ো বাতাসে আর কলমটি শিয়রে কাঁদবে।
আমার কলমকে
তুই দেখে রাখিস
সে বড় একা
নিশি-দিন থাকত
সাথে
প্রিয় সে-সখা
শুধু বাস্তবতায়
নয় আঁকা
কল্পতেও সে
ছিল
আমার হাতে ছোঁয়ানো
ময়ূর পাখা।
অনন্ত দুঃখেও
ছাড়িনি তাকে,
ভীত হয়নি মরণটাকে
দেখে;
তার শেষ আশ্রয়টা
কোথায় মিলবে?
আমি আঙুল তুলে
দেখিয়ে গেলাম
তোর দিকে।
তুই যত্ন করে
রেখে দিস
আমার প্রিয়
সখা।
হেয়ালির আঁড়ালে
লুকাতে ভালবাসি। মেঠ
পথে গাইতে ভালবাসি। শুধু
চাই না দোয়েল-শ্যামার পাকা বাড়ি। একটি কথা-
কতো কাজ বাকি,
বলতে পারিস? পারিশ্রমিক পাব তো আমি? আচ্ছা! ভুল হলে ক্ষমা করে দিস।
শত-সহস্র কথার
মাঝে
আমি এঁকে যাব
তোদের চিহ্ন,
তোরা অপর ন’স
তোরা-আমি অভিন্ন;
সংক্ষিপ্ত পরিসরে
নীরালা কুঠিরে
রাত্র জেগে
বৃষ্টির আবেগে
লিখেছি যা
তা অতি নগণ্য।
পাত থেকে ফেলে
দেওয়া
খাবারের উচ্ছ্বিষ্টের
মত জঘন্য,
যাঁদের করতে
চেয়েছি অনন্য-
আমি বরাবর-ই
তাঁদের কাছে বন্য,
তবুও আমি যে
ধন্য
তোদের ভালবাসা
অনুরাগে।
ভুলিস না, ঐ
প্রাসাদে হাসি হেসে-
অনেক রয়েছে,
অনেক দেখবি সিন্ধুকে ভরা মণি-মুক্তা। গেঁয়ো, অপরিপক্ক বাঁশ, ঘুণে ধরা অসংখ্য ছিদ্রের মালিক; জলের অস্তিত্ত্ব
মেলে না এই ছেড়া চালুনিতে।
তোদের দেখে
একটা আশা মনে জেগে উঠেছে-, আয় সবুজের পথে, আয় মশী হাতে সহস্র পৃষ্ঠায় আঁচড় কাটি। অবশেষে-
চিরকাল রাখবি
তোদের হৃদয়ে- বিশ্বাস করি, সাধনা-সঙ্গিতে, সাহিত্যের গন্ডিতে আবার তোদের সাথে দেখা
হবেই।
ইতি
টগর
টগর এখন কোথায়?
আগন্তুককে প্রশ্ন করল দিপু। হাসপাতালে শয্যাশায়ী ছিল, বাঁচবে কি না সন্দেহ! আগান্তুকের এই
কথা শুনে দিপু বলে উঠল, না, তা হতে পারে না, আমি যাব তার নিকট। তাঁর স্বামী বলল, আচ্ছা ঠিক আছে, আমরা
সবাই যাব একসাথে টগর-কে দেখতে। এই বলে তাঁরা তিন জন বেরিয়ে পড়ল টগর-এর উদ্দেশ্যে।
(ছোট গল্প)