প্রথম অংশ
পাড়া-গাঁয়ের ছোটো
ছোটো পথ পেরিয়ে খরস্রতা সাগবাড়িয় ও কপোতাক্ষের মাঝে গড়ে উঠা সেতুপুর পল্লীতে উজান-ভাঁটি
খেলা করে বর্ষা মৌসুমে। চরের কাঁদা-মাটিতে তৈরি আধা-শুকনো বাড়ির ছন্-গোলপাতার ছাউনি
মিশে আছে দখিণা বাতাসে। কপোতাক্ষ যখন মায়ের মতন তখন সাগবাড়িয়া বৈরী। আবার বিপরীত ধারায়
প্রবাহিত হয়, কখনো সম ধারায়। ভিষণ একাকী তটিনির
বুকেতে শুশুকের আনাগোনা বিভ্রান্তি আনে উদাস মনের পথিককে। অচেনা অনেক পাতার
ভিড়ে ছোটো ছোটো লাল কাঁকড়ার সুচারু পায়ে হেঁটে চলা, কখনো গহীন রাতে
মাঝিদের নৌকার আওয়াজ সিড়সিড় করে দু’কর্ণে। নিভৃত পল্লীতে শৈশব
গড়ে উঠেছে দিপু’র। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পদার্পণ
তাকে টেনে এনেছে তট-তটিনির মাঝখানে। অজিত সেন -এর সর্ব কনিষ্ট কন্যা হওয়ায়, অনেক অদরের পুত্তলি দিপু। সে স্কুলে যায় একলা
মনে একলা সঙ্গিতে।
দিপু, তার শৈশব স্মৃতিকে ভুলে যেতে বসেছিল ইট-পাথরের বর্গ ক্ষেত্রে। শৈশবের বন্ধু টগর
আর বিপুল, তাও ভুলতে বসেছে দিপু। কিন্তু দিপুকে হঠাৎ
তাদের বাড়ি- পেয়ে যাবে তা সে ভাবিনি। তাই ছোট বেলার স্মৃতি কিছুটা হলেও উকি দিয়ে উঠলো দিপুর মনে। টগরকে বসতে দিয়ে
সে ভাবতে শুরু করে----
আমার প্রজাপতি মন/ফড়িংও
ডানায়
এদিক সেদিক ঘুরে
বেড়াই/যেভাবে মানায়
আমার প্রজাপতি মন/ফড়িংও
ডানায়
আমার পায়ে চলা স্যন্ডেলটা/দেখ
কত ভারি
ইস্কুলেতে যাই যে
আমি/ তা ধিন তা ধি করি
আমি বেণী করি চুলে/আটকানো
ফিতায়
আমার বয়ে ভরা ব্যাগটা/কাঁধের
উপর রাখি
শ্যামলা বরণ কন্যে
আমি/চোখে কাঁজল আঁকি
ফিরতি পথে একলা
ফিরি/কান দেইনা কথায়
(অনেকটা দিকভোলা
চঞ্চলা নয়নে মেতে থাকে দিনভর স্কুলে।)
কিরে ---, থমকে গেলি যে? হঠাৎ টগর বলে উঠলো
দিপু-কে। দিপু হতচকিত হয়ে
বলল, একটু শৈশবে ফিরে গিয়েছিলাম, সেই কপোতাক্ষের পাড়ে- সেতুপুর গ্রামে। তোর কি মনে আছে
সেতুপুর গাঁয়ের কথা, টগর? টগর এক বাক্যে বলে উঠলো, কি যে বলিস তুই, থাকবে না আবার, ওটাতো আমার গ্রাম। হ্যাঁ, তাইতো। আসলে ভাবতে ভাবতে বিভোর হয়ে গিয়েছিলাম। দিপু-র কথা শুনে
টগর জিজ্ঞাসা করলো, তোর কি মনে পড়ে
ওই গ্রামের কথা, দিপু? পড়ে না আবার, খুব পড়ে। কিন্তু এক যুগ কেটে
গেছে, সব কি আর আর আগের মতো আছে রে---!
নারে দিপু, নেই। অনেক বদলে গেছে, সেই মেঠ পথ হারাতে
বসেছে আধুনিক ইট-পাথরে। তাছাড়া----
তাছাড়া কি?
প্রতি বছর নদীর
গ্রাস, কেউ সাহস পায়না সেখানে বাস করতে। এই ভাল, তো ওই খারাপ।
কেন, আগে তো অমন ছিল না?
আগে তো এমন ছিল
না! আগে কি আমাদের বয়স দুই যুগ ছিল, ন্যাকা কোথাকার!
মুখ ভেংচিয়ে টগর বলল।
তা না, তবে---
শোন, আবহাওয়ার পরিবর্তনে এমন ঘটেছে আর সেদিন এখন আর নেই। বাদ দে সেসব কথা, এবার তোর খবর বল।
আমার কথা পরে শুনিস, আগে চা করে আনি- তার পরে ঠান্ডা মাথায় কথা বলিস। একথা শুনেই টগর
বলে উঠলো- চা পান করলে তো মাথা গরম হয়ে যাবে, দিপু! দিপু মিষ্টি
একটা হাসি দিয়ে বলল- তোর ফাজলামোটা এখনো যাইনি, তাই না?
টগর-ও একগাল গেসে
বলল, কি করবো অনেক দিনের অভ্যাস তো, তাই ভুলতে পারি না।
এই বলে একটা তোয়ালে
নিয়ে টগর টিওবয়েল-এর দিকে গেল। হাত-মুখ ধুয়ে উপরের দিকে চাইতেই দেখতে পেল এক টুকরো মেঘ ভেসে
যায়, কেউ যেন তাকে ঠেলে নিয়ে যায়। কোথায় যায়, কার কাছে যায়- এ প্রশ্নে বিভোর টগরের মনে একটা গানের উদয়
হলÑ
এক টুকরো মেঘ/ভেসে
বেড়ায় সারা বেলা
মনের লুকানো কথা/
বয়ে নিয়ে করে খেলা
কখনো সূর্যের কোলে/কখনো
বা আঁড়ালে
উঁকি দিয়ে যায় শুধু/
তার পানে তাকালে॥
দীঘির শান্ত জলে/সে
ঝরে পড়ে একেলা
কখনো মাথার উপর/কখনো
বা গাছে
এই দেখি সামনে বসা/
নয়তোবা পিছে॥
মনের জানালা খুলে/
গেয়ে যায় ওই সুরেলা
হঠাৎ অদ্ভুত একটা
আওয়াজে মেঘের ভেতর থেকে তার কানে আঘাত করলো। মেঘের গর্জন, কিন্তু আকাশে তো
সূর্য- বৃষ্টির আশংখা নেই, তবে---?
মুহূর্তে একটা রক্তাক্ত
কবুতর এস পড়লো টগরের পায়ের নিকট। এতক্ষণে বিষয়টা পরিস্কার হল, কেউ বন্দুকের গুলি ছুড়েছিল পাখিটাকে হত্যা করতে, তারই আওয়াজ ছিল ওটা। কিন্তু বড্ড দেরি
হয়ে গেছে, ততক্ষণে মরে সারা। শহরে এসে আরেকটা
নতুন অভিজ্ঞতা হল তার। গ্রামে ঘুঘু মারতে দেখেছে কিন্তু কবুতর মারতে দেখেনি এভাবে। দু-এক মিনিট যেতেই
একটা বালক পাচিল টপকে পাখিটা চাইলো।
ভাইয়া কবুতরটি আমাদের। ও আচ্ছা, কিন্তু এভাবে মারলে কেন? বোকা প্রকৃতির প্রশ্ন
শুনে ছেলেটি বলল, কেন- জানেন না, খাওয়ার জন্য।
টগর কখনো শোনেনি
কবুতর খাওয়ার কথা। কিছুটা বিমর্ষ হয়ে সে বলে উঠলো, এভাবে কেউ কবুতর মারে!
এখানে কি করছিস, টগর? চমকে উঠে বলল, না-- কিছু না।
দিপু বলল, টগর, রক্ত কিসের, কেটে যায়নি তো? কার সাথে কথা বলছিলি? আর অমন বেসুরো গলায় গান গাইছিল কে?
আর বলিস না, কোত্থেকে এক বালক এল, গুলি বিদ্ধ একটা
কবুতরকে নিতে। আমি অবাক হয়ে গেলাম, এভাবে কি কেউ কবুতর মারে।
এতে অবাক হওয়ার
কিছু নেই, সন্ধ্যায় শহর এলাকায় মানুষও মরে। একথা শুনে টগরের
হাত-পা আড়ষ্ট হয়ে উঠলো। দিপু শহরের এ-রূপ দেখে অভ্যস্থ হয়ে গেছে তাই কোন প্রতিক্রিয়
নেই তার মনে।
দিপু টগর-কে ভিতরে
নিয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। তাদের ঘরের ভিতর
অনেক মেহমান আছে, তাছাড়া সংসারটা
একটু ছিমছাম। দিপু টগর-কে তার
শ্বশুড়-শ্বাশুড়ির সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। একটা দেবর আছে তাকেও দেখাল। তারপর দিপু-র বড়
মেয়ে ও ছোট ছেলেকে বলল, উনি তোমাদের মামা
হন।
মামা বলতেই ভাগ্নের
জামা খোলা শুরু। আর রক্ষে নেই। দিপু-র কোন ভাই না থাকায়, মামাকে পেয়ে একেবারে
নাস্তানাবোধ করে ফেলল। অনেক দ্রুতই কেটে গেল বিকেলটা টগর-এর।
দিপু-র স্বামী সরকারী
অফিসার- তাই এখনো বাড়িতে ফেরেনি। তাই বেশ ব্যাস্ততা ও আদর যত্নের মধ্য দিয়ে দিনটা কাটিয়ে টগর
চলে গেল।--------
অনেক ভাল লেগেছে। কিন্তু বাকি অংশ কখন পাব!
ReplyDeleteসাথেই থাকুন!!!! খুব শিঘ্রই পেয়ে যাবেন। আগামী কাল দুপুরে। ধন্যবাদ!!!!!!
Deleteনতুন নতুন কবিতা পেতে ভিজিট করতে পারেন আমার সাইটে
ReplyDeletewww.valobasargolpo2.xyz